Wednesday, October 30, 2019



পূর্বদিকে মুখ করে পা দুটো সামনে সটান ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশে চেয়ে বসে আছে আব্দুল খালেক। রাজ্যের বিরক্তির ছাপ তার চোখে মুখে। একটু আগে ওঠা সুর্যের লাল আলো ঠিকরে পড়ছে মুখে। কিছুটা মুখোমুখি বসে খালেকের দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে আছিয়া। সকালের লাল মিঠে রোদ খালেকের চোখ-মুখে তৈরী করছে কি যেন এক পবিত্র ও করুণ ময়াবী আভা যা নদীর পাড় ভাঙ্গার মত ভাঙ্গছে আছিয়ার বুক। বেশ ক’মাস পর আজ সে মামা বাড়ি এসেছে। আসতে তো রোজই মন চায় কিন্তু বিয়ের পর অনেক ইচ্ছাকেই পাথর চাপা দিয়ে রাখতে হয় তাকে। তাইতো ইচ্ছে করলেই আসতে পারে না। নয়মাস হলো বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর এই দ্বিতীয়বার আসা।
ভাই.. ও ভাই কেমন আছো? ভাবলেশহীন বসে থাকা খালেককে ডাকলো আছিয়া।
নিষ্পলক, নিরুত্তোর খালেক চেয়ে রইলে আকাশের দিকেই।
আছিয়ার বড় মামার বড় ছেলে খালেক। ছোট ছেলের নাম মালেক। তার সাথে এখনো দেখা হয়নি। আছে হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত। মামা মারা গেছে আটমাসের মতো হলো। এর পর থেকে বাড়ির সবতো মালেককেই সামলাতে হয়।
কিছু সময় বিরতি দিয়ে আছিয়া আবার ডাকলো খালেককে। বার কযেক ডাকার পর পলকের জন্য চোখ নামালো আছিয়ার দিকে তার পর আবার আকাশে দৃষ্টি। শূণ্যে তাকিয়ে নিষ্পৃহ গলায় বললো - কে? তুমি কে?
জমে থাকা ব্যথা যেনো ফেনায়িত হয়ে উঠলো আছিয়ার বুকের ভেতর। নিজের অজান্তেই চোখের কোন গলিয়ে টপ টপ করে দু’ফোঁটা পানি মাটির বারান্দায় পড়ে হারিয়ে গেল নিমিষেই। অন্তর যেন কেঁদে কয়ে গেল, এ কোন পরিহাস। আজ তুমি আমাকে চিনতে পারছো না!
কাঁপা গলায় বললো, আমি আছিয়া- চিনতে পারছো না ভাই? একটু মনে করার চেষ্টা করো, সেই যে.. বলেই থেমে গেল। হেমন্তের ঠান্ডা বাতাসের মতো করুণ সে কন্ঠ বাতাসেই মিলিয়ে গেল। নিজেই নিজেকে বললো, কি আজ আর মনে করিয়ে দেবো তোমাকে! যা মনে করাতে চাই তা যে আজ আমার মুখে প্রকাশ করার অধিকার নেই।
পাঁড়ভাঙ্গা নদীর মতো তোলপাড় হচ্ছে আছিয়ার ভেতরে কিন্তু খালেকের ভাবান্তর নেই। খালি গায়ে আধছেড়া লুঙ্গী আর ধুলো ময়লা জড়ানো পা নিয়ে বসে আছে নিস্তরঙ্গ। বুকের হাড়গুলো গোনা যায়। চোখ ঢুকে গেছে কোটরে তবুও তা ভীষণ স্বপ্নাতুর এখনো। আছিয়া তার পাশে রাখা ব্যাগ থেকে বের করলো কলার পাতায় মেড়ানো একটু স্বন্দেশ। একেবারে টাটকা, এই সকালেই শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার পথে কিনেছে নেঙুড়াহাট থেকে। ভবেশ ময়রার দোকান, খুব নামকরা মিষ্টি ঘর। পাতাটা খুলে আছিয়া স্বন্দেশ বাড়িয়ে ধরলো খালেকের দিকে।
ভাই একটু খাও। কতো পছন্দ ছিলো এই স্বন্দেশ তোমার। একটু খাও, ভাল লাগবে।
আজকাল খালেক কোন খাবারই মুখে তুলতে চায় না। সময় নিয়ে ভালবেসে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছু খাওয়ানোর মতো সময় এখন আর কেউ তার পেছনে ব্যয় করে না। আর তাছাড়া কারই বা সময় আছে। সংসারটা চালানো আগে জরুরী।
হাত বাড়িয়ে খানিকটা স্বন্দেশ মুখে পরে নিলো খালেক। মুহুর্তেই ওয়াক থু বলে বের করে দিলো। চিলের মতো ছো মেরে আছিয়ার হাত থেকে কলাপাতা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো রাস্তায়। রেগেমেগে চিৎকার করে উঠলো- খাওয়া যায়? তেতো বিষ। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে বামপাশের চোখের কোনে এক ফোঁটা জল জমলো আছিয়ার। এই জল কারণে না অকারণে তার ব্যখ্যা সে জানেনা। শুধু স্বগোতক্তির মত বললো- কি নিষ্পাপ কি পবিত্র একজন মানুষ অথচ তার ভাগ্য কি নিদারুণ।
তুমি কে গো, একটু সরে যাও দেখি এখান থেকে। ওই যেন কারা আসছে দেখতে দাও একটু- বলে বারান্দার কিনারে এগিয়ে গেল খালেক। একদল মানুষ উত্তরদিক থেকে গান গাইতে গাইতে কাঁচি হাতে দক্ষিণের দিকে মাঠে যাচ্ছে ধান কাটতে। এই লোকগুলো বাইরের গ্রাম থেকে এসেছে শয়লার একব্বর মোল্লার বাড়িতে আমন ধান কাটার কাজ করতে। প্রতি বছরই আসে। বারান্দার কাছাকছি আসতেই খালেক গলা বাড়িয়ে বললো ও ভাই তোমরা কারা? কোথায় যাচ্ছ? দলের মধ্যে থেকে একজন বললো কেনরে পাগলা যাবি না কি আমাদের সাথে? আমরা ধান কাটতে যাই।
কথা শুনে হো হো করে হাসতে শুরু করলো খালেক। টানা মিনিট দুয়েক হাসার পর হঠাৎ থেমে গেল। আরেকবার উঁকি দিয়ে তাকালো লোকগুলোর দিকে- ততক্ষণে তারা দক্ষিণদিকে অনেকটা এগিয়ে গেছে। খালেক পেছন দিকে সরে এসে আবার শাস্ত হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল। আকাশের দিকে চোখ করে গাইতে শুরু করলো-
‘ও দূরকে মুসাফির হাম কো ভি সাথ লে লে রে
হাম কো ভি সাথ লে লে হাম রহে গেয়ে একেলে...’
যেন হুড়মুড় করে ভেঙ্গে যেতে চাইছে আছিয়ার ভেতরটা। না পারছে সইতে না পারছে কউকে বুঝাতে। কি মানুষ কি হয়ে গেল।
আটচালা মাটির ঘরের পূর্বপাশের বারান্দায়দিন-রাত শিকলে বাঁধা থাকে খালেক। আজ দু’বছর হলো তার পায়ে শেকল উঠেছে। সাথে ওই শিকলে আটকে আছে স্বযতনে লালন করা আছিয়ার যত স্বপ্ন। যে স্বপ্নের কথা আছিয়া ছাড়া জানতো শুধু খালেক। আজ আর তা কেউ জানে না।
হঠাৎ মালেকের গলা শুনে কেমন যেন চমকে উঠলো আছিয়া- বু কেমন আছ? কখন এলে?
এই তো এলাম রে ভাই। তুই কোথায় ছিলি? দেখছিনা যে।
মালেক গিয়েছিল বিলের তলায়। এক খন্ড জমিতে কিছু ধান ছিলো ওটা কাটতে।
-সকালে উঠে ছুটেছিলাম মাঠে, এখন আসলাম। বু চলো বাড়ির ভেতরে যাই। সকালের খাববারের সময় হয়ে গেল। এখানে বসে থেকে কোন লাভ নেই শুধু কষ্ট বাড়বে।
বারান্দা থেকে নেমে মালেকের পিছন পিছন বড়ির ভেতরে পা বাড়ালো আছিয়া অথচ দৃষ্টি পড়ে রইলো খালেকের উপর যতক্ষণ দেখা যায়।
গরম ভাত, বাগান থেকে তুলে আনা বুনো কচুর লতি আর পুটি মাছের ঝোল। কিন্তু ভাত গলা দিয়ে নামছে না আছিয়ার। খাওয়া থামিয়ে মুর্তির মতো বসে আছে। কত কথা থেকে থেকে তার মনে আসছে। এই চাটাইয়ের বেড়া দেয়া রান্নাঘরে কাঠের পিঁড়িতে বসে কতোবার একসাথে ভাত খেয়েছি সবাই। যখনি এই বাড়িতে এসেছি ও খ্যাপলা জাল নিয়ে নেমে যেতো পুকুরে আর আমি পুকুরঘাটে পানির উপর নুয়ে পড়া জবাফুলগাছটার উপর বসে মাছ ধরা দেখতাম। এই পুকুরে একসাথে কত ডুব সাঁতার খেলেছি। উত্তরের বিলে ভর দুপুরে ছুটে গেছি শাপলা তুলতে। গোয়াল ঘরের পেছনে বুড়ো ছাতিম গাছের নিচে মেতেঠি এক্কা দোক্কা খেলায়। দিনের আলো নিভে এলে পুকুরের উত্তরপাশের বাঁশবাগনে রাজ্যের পাখিদের কলরব শুনতে শুনতে একসাথে বাড়ি ঢুকে বারান্দায় বসেছি আর চেয়ে থেকেছি সাদা বকের উড়ে যাওয়ার দিকে। এমনি করে কখন যে দুটি কচি প্রাণ এক হয়ে গেছে তা কেউ বুঝতে পারিনি।
একবারের কথা খুব মনে পড়ে। সেবার বাড়িতে মামী ছাড়া অন্য কেউ নেই। কলেজ থেকে এসে ও নেমে গেল পুকুরে মাছ ধরতে। অমি যথারীতি ফুলগাছের উপর উঠে পড়লাম। একটা করে ফুল ছিড়ি আর ওর গায়ে ছুড়ে মারি। কপট অভিমান দেখায় তবে বিষয়টি যে তার ভাল লাগছে তা বুঝতে পারি। এ ডাল থেকে ও ডালে হাত বাড়াচ্ছি ফুল ছিড়তে। অসতর্ক মুহুর্তে হঠাত গেল পা পিছলে।ভয় পেয়ে মাগো বলে চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। লজ্জায়আর চোখ খুলতে পারি না। হাটু অব্দি পানির মধ্যে দাড়িয়ে হাতের জাল ফেলে খালেকভাই আমাকে ধরেছে। যখন চোখ খুললাম তখন দ্রুত কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে বললো- ভাগ্যিস কেউ দেখেনি।
ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে উঠলো আছিয়া। মামী তা লক্ষ্য করলেন। কি রে মা, তোর আবার কি হলো? ভাত মুখে দিচ্ছিস না, নিজের মনে হাসছিস।
মামীর কথায় সম্বিত ফিরে পেল। খানিকটা লজ্জাও পেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো- না মামী কিছু না। এই তো খাচ্ছি। তুমি খাবে না মামী?
খেয়ে নে মা। আমি খালেকের মুখে কিছু দিয়ে আসি, তা না হলে ওই খাবার কেমন করে আমার গলার নিচে নামাবো। অমি যে মা।
প্লেটে কিছু ভাত নিয়ে বের হয়ে গেলেন খালেকের মা। মা ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারে না খালেক। অন্য কেউ খাবার নিয়ে গেলে মুখে তোলে না। চিৎকার জুড়ে দেয় আর দূরে ছুড়ে মারে প্লেট।
-আয় আব্বা, একমুঠো ভাত খেয়ে নে। এমন করে না খেয়ে আর কয় দিন বাঁচবি!
-আবার তুমি ভাত এনেছো? আমার তো ভাতের খিদে লাগে না। আমার খাওয়া লাগবে না, একবার শুধু শিকলটা খুলে দাও মা। বিড়বিড় করে বলে খালেক। কণ্ঠস্বর যেন নীড়হারা ডাহুক সাবকের সন্ধ্যাবেলার আর্তনাদের চেয়ে করুণ।
কচুর লতি দিয়ে ভাত মাখিয়ে এক লোকমা জোর করে খালেকের মুখে গুঁজে দিয়ে আচলে চোখ মোছে মা।
সোনার টুকরো ছেলে আমার। যেমনি ছিলো লেখাপড়ায় তেমনি আচার ব্যবহারে। কেমন করে যে কি হয়ে গেল। কেশবপুর কলেজে আইএ পড়ার সময় প্রথম মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। কিছু দিন ভাল থাকে আবার কিছু দিন উন্মাদ হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল। টানা আড়াইমাস পর বাড়ি ফিরলো। কদিন যেতে না যেতে আবার অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। চিৎকার করে, মানুষের বাড়িতে ঢুকে যায় সময় অসময়ে। লাঠি নিয়ে তেড়ে যায় কারো উপর। বাধ্য হয়ে পায়ে শিকল দিতে হয়েছে।
অনেক সময় পর পর মায়ের হাত থেকে এক লোকমা ভাত মুখে নিয়ে একটু হাসে তারপর চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কি যেন বলে। খুব ছোটবলা থেকেই সংসারে অস্বচ্ছলতা ভেতর থেকে উপলব্ধি করেছিলো খালেক। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ খুব অল্প বয়সেই তাড়া করেছিলো তাকে। মায়ের বেশ মনে পড়ে যে বছর খালেকের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন সেই বছর থেকেই সে মনমরা হয়ে যায় বিড়বিড় করে একা একা কথা বলা শুরু করে। কেমন যেন সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় ছেলেটা।
আছিয়ার এই বাড়িতে আজই হয়তো শেষ আসা। দুনিয়াতে আপন বলতে তার কেউ নেই। জন্মের সময় মা মারা গেছে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় ট্রাক চাপায় মারা গেছে ভ্যান চালক বাপ। চাচাদের সংসারে কেটেছে কিছু কাল এর পর বিয়ে হয়েছে রতনদিয়া গ্রামের এক অনাথ ছেলে শফিকের সাথে। অনেক চেষ্টা তদ্বির করে শফিক গত সপ্তায় ঢাকার একটি গার্মেন্ট কারখানায় নাইটগার্ডের কাজ যোগাড় করেছে। একই কারখানায় স্ত্রীর জন্য হেলপারের একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। আজ রাতে আছিয়াকে নিয়ে সফিক ঢাকা চলে যাবে তাই এসেছে একবারের জন্য খালেককে দেখতে।
মা তখনো খালেককে খাওয়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আছিয়া এসে বারান্দার সামনে দাড়ালো।
-মামী দোয়া করো, চলে যাচ্ছি। কেমন যেন দীর্ঘশ্বাসেরসাথে বললো আছিয়া।
-চলে যাবি মা? আমার খালেকের জন্য আল্লার কাছে একটু দোয়া করিস। ভালো থাকিস মা।
খালেকের উদাস চোখের দিকে তাকিয়ে আছিয়া বললো -আসি ভাই।ভালো থাকো।
খালেক হয়তো কিছুই শোনেনি। নিশ্চল-নিশ্চুপ চেয়ে আছে দূরের পথের দিকে। আছিয়া ধীরে রাস্তার দিকে পা বাড়ালো। যেন নিজের শরীটা নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছে। পাথরের মত ভারী হয়ে ওঠা পা দু'টো কিছুটা সামনে এগুতেই খালেকের কন্ঠ।
‘ও দূরকে মুসাফির হাম কো ভি সাথ লে লে রে
হাম কো ভি সাথ লে লে হাম রহে গেয়ে একেলে...’
গানের সুর যেন হিমশীতল বাতাস হয়ে জমিয়ে দিলো আছিয়ার বুক। মুহূর্তে ফিরে তাকালো খালেকের দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে গেয়ে চলেছে সে। শাড়ির আঁচলে চোখের পানি আড়াল করে আছিয়া আবার পা বাড়ালো সামনে। কানে বাজছে ‘হাম কো ভি সাথ লে লে হাম রহে গেয়ে একেলে...।’
শয়লাহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে আসতেই বুকের তলে সজোরে আঘাত করতে শুরু করলো হাজারও পুরোনো দিন। এই স্কুল, এই মাঠ- এর পরতে পরতে কতো স্মৃতি। এই স্কুলের প্রথম বৃত্তি পাওয়া ছাত্র খালেক। এলাকার কতো মানুষ সেদিন ওকে প্রশংসা করতে এসেছিল। ও নাকি গর্বিত করেছিলো এই এলাকাকে। আজ তাদের অনেকেই হয়তো খালেকের খবর রাখে না। প্রাইমারী স্কুল ছাড়িয়ে পরের মাঠটা শয়লাহাট নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণ ঘোষ স্যারের অপার স্নেহ ছিলো খালেকের মাথার উপর।
অনেক কিছু এখনো খাপছাড়া মনে হয় তারপরও কেমন যেন এই নগর জীবনের সাথে নিজেকে অনেকখানি মানিয়ে নিয়েছে ধান ক্ষেতের আইলে ঘাস ফড়িংয়ের পেছনে ছুটে বেড়ানো আছিয়া। এইতো সেদিনের কথা গ্রামের বেগুন ক্ষেতে দেখতে পাওয়া একটি বুলবুলির পিছনে ছুটেছে সারা দিন। যার অগনতি প্রহর কেটেছে ফিঙ্গে আর দোয়েলের শীষ শুনে তার হৃদয় আজ বিবর্ণ বড় বড় গাড়ির হুইসেল আর কারখানার সাইরেনে। বাস্তুচ্যুৎ সম্বলহীন আছিয়া আর কখনোই ফিরে পাবে না তার পুরোনা দিনগুলো। ইট পাথরের শহরে হৃদয়হীন পয়সাওয়ালাদের মুনাফার যোগনদার একজন সস্তা শ্রমিক হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা। আজকের থেকে কালকের কাজের চাপ আরো বেশি। হৃদয়ের বেসাতি এই শহরে কেউ করে না। ভালোলাগা মন্দলাগা সব এখানে বানিজ্যিক।
তিন বছর আগে একটি ব্যাগে দু’একটি জামা কাপড়, কাথা-বালিশ আর কয়েকটি স্টিলের প্লেট-গ্লাস নিয়ে বাসে চেপেএই শহরে আসা। হেমন্তের ঠান্ডা বাতাস পেছনে ফেলে ইঞ্জিনে শব্দতুলে এগিয়ে যায় বাস আর স্মৃতির ঢেউ পাঁড় ভেঙ্গে চলে আছিয়ার বুকে। একটু করে পথ পাড়ি দেয় আর বাতাসের গন্ধ যেন বদলে যেতে থাকে। গভীর দীর্ঘশ্বাসে বুক ভারী থেকে আরো ভারী হয়ে ওঠে। জীবনের শাশ্বত স্বপ্নকে পেছনে ফেলে শুধুমাত্র জীবন ধারণের জন্য ছুটে চলা। তারপর স্বামী-স্ত্রী মিলে সকাল থেকে রাত অবধি কারখানায় কাজ। কোন দিকে তাকানোর ফুরসুত নেই। বসবাস শাজাহানপুর ঝিলপাড়ের বস্তিতে। মাঝে একবার শুনেছিলো খালেক শিকল ছিড়ে পালিয়েছে। নিকটজনদের কেউ তার সন্ধানে খুব বেশী আগ্রহী হয়নি। শুধু মায়ের দিন বয়ে যায় চোখের পানি ফেলে। কারখানায় আসা যাওয়ার পথে আছিয়া ঠিকই মনে মনে খোঁজে তাকে। শফিককেও মাঝে মধ্যে বলে সময় পেলে খালেক ভাইয়ের খোঁজ করো। আজ অবারো বলেছে একবার। শফিক বলে পাগল মানুষ, কোথা থেকে কোথায় গেছে- খুঁজে কি পাওয়া যায়? বেঁচে আছে কি না তারও বা ঠিক কি?
শেষ কথাটা শেলের মতো বিঁধলো আছিয়ার কান থেকে বুকে কিন্তু বলতে পারলো না কিছুই। বুকের ভেতরটা কেমন ভারী হয়ে উঠলো। শরীরটাও ভাল যাচ্ছেনা কিছুদিন ধরে। পেটে বাচ্চা এসেছে সাতমাস হলো। মাতৃত্বকালীন ছুটি মিলছে না। ছুটি চাইলে ফ্লোর ইনচার্জ বলে চাকরি ছেড়ে দাও নয়তো বিনা বেতনে ছুটি নাও। এই অবস্থায় ওভারটাইমসহ ১২ ঘন্টা ডিউটি করে যারপরনাই ক্লান্ত হয়ে যায় আছিয়া। আজ একটু বেশি ক্লান্ত লাগছে। শফিকের নাইট ডিউটি। ফিরতে সেই ভোর ছয়টা। না খেয়েই বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় আছিয়া। কিন্তু ঘুম আসছে না। কেমন যেন অস্থির লাগছে ভেতরটা। শেষরাতের দিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। ঘুমের ঘোর আসতে না আসতেই কানে ভেসে আসে সেই সুর-
‘ও দূরকে মুসাফির হাম কো ভি সাথ লে লে রে
হাম কো ভি সাথ লে লে হাম রহে গেয়ে একেলে...’
ছুটে গিয়ে ঘরের জানালা খোলে আছিয়া। নিয়নের ঝাপসা আলোয় দেখতে পায় ছেড়া নেংটি পরে, অর্ধেকটা শিকল পায়ে নিয়ে টানতে টানতে ওভারব্রীজের নিচ দিয়ে খালেক এগিয়ে যাচ্ছে সামনের রেল লাইনের দিকে। শিকলে বাঁধা আছিয়ার স্বপ্ন গড়াগড়ি খাচ্ছে রাস্তার ধুলোয়। সে চিৎকার করে বলার চেষ্টা করছে- ভাই আমি আসছি, তুমি দাঁড়াও.. কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছেনা। কানের মধ্যে কেবলই জোরালো হচ্ছে খালেকের কন্ঠ-
.. শুনি হ্যায় দিল কি রহে খামোশ হ্যায় নিগাহে
নাকাম হাসরাতো ক্যা উঠনেকো হ্যায় জানাজা
চারো তরাফ লাগে হ্যায় বরবাদিও ক্যা মিলেরে
হাম কো ভি সাথ লে লে হাম রহে গেয়ে একেলে...
দানবের মতো হুঙ্কার দিয়ে ছেড়ে গেল একটি ট্রেন। ঘুম ভেঙে গেল আছিয়ার। লাফ দিয়ে উঠে বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগলো সে। ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। বুকের ভেতর বেদনার মতো বেঁজে উঠতে চাইছে হারানো দিন।
-মঈনুল হক

No comments:

Post a Comment